শারীরিক সম্পর্কের সময় অনেক নারীর তলপেটে অসহ্য যন্ত্রণা হয়। অনেকের আবার ঋতুস্রাবের সময়ও তলপেটে ব্যথা হয়। বেশিরভাগ মানুষই এই বিষয়গুলোকে এড়িয়ে যান। তবে ঘন ঘন এই ব্যথার পেছনে লুকিয়ে আছে ‘এন্ডোমেট্রিওসিস’ নামে এক অসুখ। যা অজান্তেই দিনে দিনে মহামারির আকার ধারণ করেছে।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ১৭ কোটি ৬০ লাখ নারী এই এন্ডোমেট্রিওসিসের সমস্যায় ভুগছেন। চলুন তাহলে জেনে নেওয়া যাক যন্ত্রণাদায়ক এ অসুখটির কিছু লক্ষণ।
১. ঋতুস্রাব শুরুর আগে অল্পস্বল্প পেট ব্যথা প্রায় সকলেরই হয়। কিন্তু ব্যথা যদি সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়, তাহলে ব্যথা কমাতে যেমন তেমন পেইন কিলার না কিনে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন। পলিসিস্টিক ওভারি হলে সিস্ট থাকবেই। তবে এই সিস্টগুলো খুব একটা সমস্যা তৈরি করে না। কিন্তু সিস্টগুলো যদি রক্তে পরিপূর্ণ হয়, তাহলে এন্ডোমেট্রিওসিস-এর লক্ষণ।
২. জরায়ু বা ইউটেরাসের এক প্রয়োজনীয় একটি আবরণ হল এন্ডোমেট্রিয়াম। বয়ঃসন্ধির সময় থেকে সন্তান ধারণের সময়কালে মেয়েদের জরায়ুতে নানা পরিবর্তন ঘটে। ঋতুস্রাবের পর জরায়ুর মধ্যে থাকা এন্ডোমেট্রিয়াম আবরণটি ক্রমশ পরিপূর্ণতা পায়। এই সময়ে গর্ভবতী না হলে এন্ডোমেট্রিয়াম আবরণটি ক্রমশ জরায়ু থেকে ছিঁড়ে পড়ে যায়। ২৮ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে এন্ডোমেট্রিয়াম আবরণটি জরায়ু থেকে খসে পড়ে গেলেই মাসিক বা ঋতুস্রাব শুরু হয়।
এন্ডোমেট্রিওসিসে আক্রান্ত রোগীর জরায়ুর ভিতরে ছাড়াও এর বাইরের দিকে ডিম্বাশয়ে (ওভারিতে), ডিম্ববাহী নালী বা গর্ভনালীতে (ফ্যালোপিয়ান টিউবে) এমনকি কখনও কখনও রেক্টাম বা মলাশয়ের গায়ে এন্ডোমেট্রিয়াম আবরণ তৈরি হয়। ঋতুস্রাবের সময় জরায়ুর বাইরের দিকের এই সব অস্বাভাবিক এন্ডোমেট্রিয়াম টিস্যুগুলোও ছিঁড়ে যায়। ফলে অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ হতে থাকে। আর এই কারণেই এই সময় তলপেটে অসহ্য ব্যথা করতে থাকে।
এই রক্তক্ষরণের ফলে ওভারির ভেতরে রক্ত জমে যে সিস্ট তৈরি হয় তাকে ‘চকোলেট সিস্ট’ বলা হয়। অজ্ঞতা ও অবহেলার ফলে অনেক সময় ডিম্বাশয়ে ও জরায়ুতে এন্ডোমেট্রিওসিসের কারণে টিউমারও হতে পারে। সেক্ষেত্রে জটিলতা এবং সমস্যা অনেকটাই বেড়ে যেতে পারে।
এন্ডোমেট্রিওসিসের সমস্যায় করণীয়?
এন্ডোমেট্রিওসিস এমনই এক অসুস্থতা যা সম্পূর্ণ ভাবে সারিয়ে তোলা সম্ভব নয়। তবে ডায়াবেটিস বা হাইপ্রেশারের মতো নিয়ম মেনে নিয়মিত চিকিৎসার সাহায্যে এই অসুখ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
চিকিৎকের পরামর্শ অনুযায়ী, ডায়াথার্মি, লেসার বা ল্যাপারোস্কোপির সাহায্যে এন্ডোমেট্রিওসিসের সমস্যা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। তবে প্রতি মাসে যদি ঋতুস্রাব বা পিরিয়ডের সময় তলপেটের অসহ্য যন্ত্রণা হতে থাকে তাহলে দেরি না করে কোনো স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ করা জরুরি।
পিরিয়ডের অসহ্য যন্ত্রণা দূর করার প্রাকৃতিক উপায়
নারীদের পিরিয়ড কিংবা মাসিক মোটেই কোন লুকোছাপার বিষয় নয়। এটি নিয়ে বিস্তর আলোচনা চলছে সবখানেই। প্রতি মাসেই একটি নির্দিষ্ট সময় ধরে (তিন থেকে সাত দিন) প্রতিটি পূর্ণবয়স্ক নারী এ অবস্থার মুখোমুখি হন। পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে বেশিরভাগ নারীই অসহনীয় ব্যথা ও যন্ত্রণা সহ্য করে থাকেন। অনেক কিশোরী ও তরুণীর স্কুল-কলেজে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। ঘরের কাজে মন বসাতে পারেন না অসংখ্য গৃহিণী। কিন্তু প্রতি মাসেই এমন যন্ত্রণা সহ্য করার চাইতে কীভাবে এটি উপশম ও প্রতিকার করা যায়, সেটি জেনে রাখা উত্তম নয় কী?
সে লক্ষ্যেই আমাদের আজকের ফিচারে আপনারা জানতে পারবেন পিরিয়ডের ব্যথা উপশম করার কয়েকটি সহজ ঘরোয়া উপায়। চলুন তবে জেনে আসা যাক-
সুষম খাবার
মাসিক চলাকালীন অবস্থায় অবশ্যই আপনাকে যথেষ্ট পরিমাণ স্বাস্থ্যকর ও সুষম খাবার খেতে হবে। যেকোন ধরণের ফাস্টফুড, দুগ্ধজাত খাবার ও তেলেভাজা খাবার এ সময় এড়িয়ে চলার চেষ্টা করুন। প্রচুর পরিমাণে ফল, আঁশযুক্ত খাবার, শাকসবজি খেতে থাকুন। কোনভাবেই পেট খালি রাখবেন না। দু’ঘণ্টা পর পর খেতে থাকুন।
প্রচুর পানি পান করা
অনেকের একটা ভুল ধারণা আছে যে মাসিক চলাকালীন সময়ে পানি পান করা কমিয়ে দিতে হবে। এটি কিন্তু একদম ভুল ধারণা। এ অবস্থায় প্রচুর পরিমাণে পানি পান করা উচিৎ। প্রতি ঘণ্টায় অন্তত এক গ্লাস পানি পান করবেন। শুধু পানি খেতে ইচ্ছে না করলে আপনি ফলের টাটকা শরবত পান করতে পারেন। তবে হ্যাঁ, বাজারে যেগুলো পাওয়া যায় ওগুলো এড়িয়ে চলাই উত্তম!
মাল্টিভিটামিন গ্রহণ করা
পিরিয়ডের ব্যথা যদি একদম অসহনীয় পর্যায়ে চলে যায় তাহলে আপনি চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে মাল্টিভিটামিন বা মিনারেল খেতে পারেন। তবে বেশিরভাগ চিকিৎসক পরামর্শ দেন যে ওষুধ না খাওয়াই ভালো। নিজে নিজে চিন্তা করে কোনভাবেই ওষুধের আশ্রয় নেবেন না।
হালকা ব্যায়াম
পিরিয়ড অবস্থায় কোন ধরণের ব্যায়াম করা যাবে না, এটি একদম ভ্রান্ত ধারণা। হালকা ব্যায়াম যেমন হাঁটাহাঁটি করা, সাঁতার কাটা, ইয়োগা বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে করতে পারবেন আপনি। প্রথম দু’দিন খুব ভারী যেকোন কাজ কিংবা ব্যায়াম করা থেকে বিরত থাকুন। পরবর্তী দিনগুলোতে চাইলে করতে পারেন কিন্তু অবশ্যই শরীরের অবস্থা বুঝে।
আরো পড়ুন মা হওয়ার পর পেটের মেদ কমান
তলপেট ম্যাসাজ
ব্যথা যদি একদম তীব্রতর হতে থাকে সেক্ষেত্রে তলপেটে গরম পানির সেঁক দিতে পারেন খুব আলতোভাবে। এক্ষেত্রে গরম পানির বিশেষ এক ধরণের ব্যাগ আছে, সেটি ব্যবহার করতে পারেন। এছাড়া তলপেট ম্যাসাজ করতে পারেন। অনেকটুকু আরাম বোধ করবেন।
আশা করি, এ ঘরোয়া টিপসগুলো অনুসরণ করে আপনি পিরিয়ড চলাকালীন অবস্থাতেও নিশ্চিত থাকতে পারবেন। এগুলোতেও যদি কোনভাবে আপনার উপকার না হয় তাহলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন। শুভকামনা আপনার জন্য।
Leave a Reply