সংসার শুরু করেছেন? শুরু হলে তা কেমন চলছে? বোঝাপড়া কেমন? দুজনের চলাফেরা, আচার-আচরণ মানিয়ে নিতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো? প্রত্যেকেরই দোষ-গুণ থাকে। আর এই দোষ-গুণ নিয়ে চলতে হয় জীবনভর। কাউকে বিরক্ত করা খুবই সহজ। কিন্তু সঙ্গীর মন জুগিয়ে চলার বিষয়টি নিয়ে আমরা কখনো কেউ ভাবি না। টানাপোড়েনের চেয়ে যে সমঝোতা ভালো, সেটা আমলে নিতে চাই না।
‘খিটিমিটি লেগে আছে। সংসার শুরু করেছি কম তো সময় হলো না। কিন্তু এখনো ওর কিছু কিছু আচরণ আমি মন থেকে মেনে নিতে পারছি না। অতিষ্ঠ আমি। ভালো লাগছে না এই সংসার। প্রেমের সংসার এখন ঘৃণার যন্ত্রণা হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ স্ত্রীর এই ক্ষোভের কথা শুনে সঙ্গে আসা স্বামী বেচারা একটু সংকোচের মধ্যে পড়লেন। স্বামীর চাওয়া হলো বেশি সাজগোজ করা যাবে না। শাড়ি পরলে যেন কোনোভাবেই পেট দেখা না যায়। বেড়াতে গেলে বা বাইরে বের হলে সব সময় স্বামীর শ্যেনদৃষ্টি। আর সহ্য হয় না স্ত্রীর। অনেক সময় বিয়ে, জন্মদিন, সাধারণ কোনো অনুষ্ঠানেও যেতে দেন না স্বামী। উপহার পাঠিয়ে দেন। চোখে চোখে রাখেন বউকে। ভাবখানা, এমনটা না করলে অন্যের সঙ্গে পালিয়ে যেতে পারেন মেয়েটি। মনোজগতের কী ভয়ংকর মুশকিল। অথচ বউটির এমন কোনো কাণ্ড করার আশঙ্কাই নেই। কিন্তু স্বামীর বাতিক যাচ্ছেই না।
আরেক দম্পতি। স্ত্রীর অভিযোগ হলো, ‘আমাকে কিছু না জানিয়ে হঠাৎ আট-দশজন অতিথি নিয়ে এল ভরদুপুরে। দুই-তিনজনের রান্না যা নিয়মিত করি তা-ই করা ছিল বাসায়। হঠাৎ এই উটকো ঝামেলা একদম পছন্দ না। নেমতন্ন করতে আমারও ভালো লাগে। বিভিন্ন পদের রান্না করা শখ। তাই বলে হুটহাট লোকজন নিয়ে বাসায় চলে আসবে এ কেমন কথা?’
আরেক ধরনের অভিযোগ শোনা গেল। ‘সব সময় এ রকম বদমেজাজ ভালো লাগে না। সব সময় রান্না তো এক রকম হয় না। মাঝেমধ্যে স্বাদ ভালো হয় না, তা আমিও বুঝি। বাচ্চাদের পরীক্ষার ফল প্রতিবার কি আমরা যে রকম চাই সে রকম হয়? ওর ব্যবসায়ে আয়-ব্যয়, লাভ-লোকসান প্রতি মাসে কি একই রকম থাকে? সংসারের খুঁটিনাটি ঝামেলা, সমস্যা, টুকটাক খরচ আমিই তো সামলাই। তাই বলে আমি কি ওর সঙ্গে একটু উনিশ-বিশ হলে বকাঝকা করি?’ বলেন স্বামীর ব্যবহারে অতিষ্ঠ এক নারী।
কেন করেন?
প্রত্যেক মানুষই বেড়ে ওঠেন ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে। কেউ ছোট আকারের পরিবারে, আবার কেউ যৌথ পরিবারে। কেউ মিশুক হয়; আবার কেউ অন্তর্মুখী। কারও পরিবার হয় রক্ষণশীল, আবার কেউ বেড়ে উঠেছেন উদারপন্থী আধুনিক পরিবেশে। বৈবাহিক বন্ধনে কার জোড়া কোথায় আছে আমরা তা জানি না। আসলে জেনেটিক, পারিবারিক, সামাজিক পরিবেশের ভিন্নতার কারণে একেকজন মানুষ একেক রকম হন। প্রত্যেকের আচার-আচরণ, ব্যবহার, সহ্য করার ক্ষমতা, আবেগ-রাগ-অনুরাগ-বিরাগের ধরন, বহিঃপ্রকাশ—সবই নির্ধারিত হয় কম বয়সেই। ভিন্ন পরিবেশে বেড়ে ওঠা দুজনকে একসঙ্গে একই ছাদের নিচে একত্র করে দেওয়ার সামাজিক প্রথারই আরেক নাম হচ্ছে বিয়ে। সুন্দর সংসার নির্বাহ, মিলেমিশে থাকা, ভালোবাসা-সম্প্রীতি-বোঝাপড়া স্বামী-স্ত্রীকেই মিটিয়ে নিতে হয়।
তাহলে কী করা যায়?
সংসারে খটরমটর লাগবে না, তা হয় না। সমস্যা যখন সহ্যের সীমানা অতিক্রম করে তখন উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। নিজেকে সামলাতে হবে সমস্যা তীব্র হওয়ার আগেই। অন্য শারীরিক রোগব্যাধির প্রকাশ ঘটে ব্যথা-যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে। সংসারের সমস্যার প্রকাশ ঘটে নানা খুনসুটি—হয়তো কেউ কেউ খুব চোটপাটের রোগ-রাগ-বিরক্তি ছাড়া নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে পারেন না। কেউ তিলকে তাল করেন। অল্পতেই এমন প্রতিক্রিয়া করেন যেন বিশ্বসংসারে মহাগোলযোগ লেগে গেছে। এমনটি যাঁদের রোগ, নিজেরা তা ধরতে পারেন না। ভাবেন, তিনি যা করছেন একদম ঠিক করছেন।
যাঁর সমস্যা তিনি যদি বুঝতেন, তবে বিশ্বসংসারে আজ এই কাটাকাটি-হানাহানি থাকত না। সমস্যা দেখামাত্র এমএস ওয়ার্ডের নতুন নতুন ভার্সনের মতো নতুন করে নেওয়ার সুযোগ থাকলে ভালো হতো। কিন্তু মানুষের মনের ভার্সন কি বদলানো সম্ভব? তবে তিনি যদি অভ্যাস বা তাঁর চিহ্নিত সমস্যাগুলোকে মেনে নিয়ে পরিবর্তিত হওয়ার চেষ্টা করেন, তবে তাঁর পাশে দাঁড়ানো সংসারের অন্যদের কর্তব্য। একে অন্যের পাশে দাঁড়ানো; দুঃখ-সুখ-সমস্যার জ্বালা ভাগ করে নেওয়াই তো সংসারধর্মের দায়।
সমস্যাকারীকে আগে মানতে হবে যে তাঁর কারণেই পরিবারে অশান্তির ঘনঘটা। সুখ-শান্তি¯ নষ্ট হচ্ছে। তবে এই সময় নিজে সমাধানের চেষ্টা না করে অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা এঁদের মধ্যে লক্ষ করা যায়। সময় নিন। নিজেকে বোঝার চেষ্টা করুন। কেন, কোন সময়, কী কারণে এমন আচরণগুলো আপনি করেন তা নিজেকে জিজ্ঞেস করুন। সমস্যার সমাধান আপনিই করতে পারবেন। একইভাবে আপনার সংসারের সঙ্গী যখন নানা সমস্যা করছেন, তাঁকে শুরুতেই একদম বাতিল করে দেবেন না। তাঁকে বোঝার চেষ্টা করুন। বোঝানোর চেষ্টা করুন। তিনি যে তাঁর সমস্যাগুলো বুঝতে পারছেন না, সেটা বোঝার জন্য সময় দিন। তাঁকে কৌশলে বোঝান। যদি একা বোঝাতে না পারেন বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে নিয়ে বোঝান।
আর ভুক্তভোগী সঙ্গী এবং পরিবারের অন্য সদস্যরা যা দিনরাত জপ করে চলেছেন, এভাবে আর সম্ভব না। না, এটা করবেন না। বরং সমাধান খুঁজুন। সমাধান আছে। কোনো কিছুই অসাধ্য নয়। কারও দোষত্রুটি নিয়ে সারাক্ষণ লেগে থাকাটা কখনোই কাম্য হতে পারে না। এতে হিতে বিপরীত হবে। সমস্যাকারীর সদিচ্ছা থাকলেও সেটা মানিয়ে নিতে তাঁর কষ্ট হবে। সবার উচিত তাঁকে বোঝার। তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করা। নিজে অনুধাবন-উপলব্ধির চেষ্টা করা। নিজেকে শুধরানোর চেষ্টা করা। সংসার তো কোনো কুরুক্ষেত্র নয়। সংসার হলো মিলবার, মেলাবার, মিলনেবর ক্ষেত্র। সংসার হলো মেলবন্ধন। [১]
বিয়ের পর সম্পর্ক টেকাতে…
বিয়ের পর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলার পরিকল্পনায় যাঁদের ঘাটতি থাকে, তাঁদের অনেককেই হাহুতাশ করতে শোনা যায়। প্রেমহীন দাম্পত্য সম্পর্কের মধ্যে সহজেই বিশ্বাসভঙ্গের ঘটনা ঘটতে পারে। এতে ভেঙে যেতে পারে সংসার। তাই সম্পর্ক যাতে টিকে থাকে, সে জন্য দুজনেরই সচেতন থাকা উচিত।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, সম্পর্ক সুরক্ষায় নেওয়া পদক্ষেপগুলোই মূলত মধুর সম্পর্ক গড়তে সাহায্য করে। সম্পর্কে বিশ্বাসভঙ্গের সন্দেহ তৈরি হলে অনেকেই সোজাসাপ্টা পদ্ধতি খোঁজেন। কেউ কেউ সঙ্গীকে সরাসরি বলে ফেলেন, প্রতারণা করলেই সম্পর্কের ইতি। এতে মনে ভয় কাজ করে। ফলে অনেক সময় এই সোজা কথাতেই কাজ হয়। কিন্তু সম্পর্ক টেকাতে ভালোবাসার সম্পর্ক মজবুত করা বেশি জরুরি। জেনে নিন করণীয়গুলো:
ভালোবাসা
মধুর দাম্পত্য সম্পর্কে প্রতারিত হওয়ার ভয় কাজ করে না। নিজের নেওয়া পদক্ষেপগুলো থেকেই মধুর সম্পর্কের সূচনা হতে পারে। গবেষকেরা বলছেন, মধুর সম্পর্কের সাধারণ বিষয়গুলো পরস্পরকে বুঝতে হবে। বাড়াতে হবে আত্মসচেতনতা। বিশ্বাস, কাছে থাকার অনুভূতি ও ভালোবাসা দাম্পত্যে সুখ বাড়িয়ে দেয়।
বোঝাপড়া
সম্পর্কের ক্ষেত্রে দুজন দুজনকে বোঝা উচিত। যদি দাম্পত্যে অসন্তুষ্টি এসে ভর করে, তবে সম্পর্কের বন্ধন আলগা হয়ে যেতে পারে। শুধু সম্পর্কের খাতিরে সম্পর্ক রাখার চেয়ে আন্তরিকভাবে কাছে থাকা, ভালোবাসা জরুরি। এ জন্য চাই বোঝাপড়া। পরস্পরকে নিজেদের কথাগুলো বুঝিয়ে বলুন, দাম্পত্যের বন্ধন শক্ত হবে।
অহেতুক সন্দেহ
পরস্পরের প্রতি অহেতুক সন্দেহ সম্পর্কের বন্ধন আলগা করে দেয়। ভয়, পরস্পরের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির মানসিকতা একবার পেয়ে বসলে সম্পর্ক গতি হারায়। সন্দেহের পরিবর্তে ভালোবাসা তৈরি করতে নিজেদের সর্বোচ্চটা করতে হবে। সম্পর্কের বাঁধন মজবুত করার বিষয়গুলোয় জোর দিতে হবে।
প্রলোভন সামলান
জীবনে চলার পথে নানা প্রলোভন সামনে আসতে পারে। প্রলোভনে পা না দেওয়ার ব্যাপারে স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই সতর্ক থাকতে হবে। পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস অটুট রাখতে হবে। দুজনের মধ্যকার দূরত্ব ঘুচিয়ে দিতে হবে। দূরত্ব কমাতে পারলে প্রলোভন ব্যর্থ হবে।
খোলামেলা আলোচনা
খোলামেলা আলোচনায় অনেক সমস্যার সহজ সমাধান মেলে। দাম্পত্যের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। স্বামী-স্ত্রীর উচিত পরস্পরের মধ্যকার যেকোনো মতভেদ নিয়ে খোলামেলাভাবে আলোচনা করা। কথা চেপে রাখলে তাতে অসন্তোষ বাড়ে। অসন্তোষের প্রভাব সম্পর্কে পড়ে।
অনুভূতি বিনিময়
ভালো লাগা-ভালোবাসার অনুভূতি প্রকাশের ক্ষেত্রে অনেকের মধ্যে জড়তা কাজ করে। অনেকে বিষয়টিকে গুরুত্বও দেন না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, অনুভূতির বিনিময় সম্পর্কের গভীরতা বাড়ায়। বাড়ায় পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, নির্ভরতা। আর অনুভূতি চাপিয়ে রাখলে ভুল বোঝাবুঝি থেকে সম্পর্কের বন্ধন আলগা হতে পারে। [২]
ভালোবাসা কারে কয়
আক্ষরিক অর্থে বলতে গেলে, নর-নারীর মধ্যে যখন সুন্দর বন্ধুত্বপূর্ণ ও পরস্পর শ্রদ্ধাবোধের সম্পর্ক থাকে, যার প্রতি নির্ভর করা যায় নিশ্চিন্তে, পরস্পর পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে, দুজন দুজনকে আঁকড়ে থাকতে চায়, একে অন্যের জন্য প্রতীক্ষা করে, দেখার আকুতি থাকে, কাছে পাওয়ার আনন্দে পাগল হয়ে যায়, দুজনে দুজনাতে মুগ্ধ…এরই নাম প্রেম বা ভালোবাসা। যে অনুভূতির জন্য সব সুখ, শান্তি, ঐশ্বর্য, বৈভব, পরিচিতি, সমাজ, সংসার সব ত্যাগ করা যায়। সম্মান-অসম্মানের পরোয়া থাকে না। দুজনার মধ্যে যদি কখনো ভুল-বোঝাবুঝি হয় বা দূরে থাকতে হয়, তখন খুব কষ্ট হয়। বিরহ ছাড়া ভালোবাসা অনুভব করা যায় না। মনে হয় যেন তাকে ছাড়া আর বাঁচব না। এই যন্ত্রণার নামই ‘ভালোবাসা’! বুকের মধ্যে আগুন জ্বলতে থাকে। যে কখনো এই যাতনা সয়নি, সে ভালোবাসার মর্ম বোঝেনি। তাই তো রবীন্দ্রনাথ গেয়েছেন “তোমরা যে বলো দিবস-রজনী ‘ভালোবাসা’ ‘ভালবাসা’—/ সখী, ভালোবাসা কারে কয়! সে কি কেবলি যাতনাময়।”
রোমান্টিক প্রেমের সঙ্গে বাঙালির পরিচয় হয় উনিশ শতকের সাহিত্যর মাধ্যমে। বঙ্কিমবাবু আমাদের প্রেমের গুরু। আর রবিবাবু আমাদের সবাইকে প্রেমে পড়তে শিখিয়েছেন। তাঁরই ভাষা দিয়ে আমরা প্রেম করি, তাঁরই ভাব দিয়ে প্রেম করি!
মধ্যযুগের সাহিত্যের বড় অংশ জুড়ে রয়েছে রাধা-কৃষ্ণ, লাইলি-মজনু, ইউসুফ-জুলেখা, শিরি-ফরহাদ প্রভৃতি। প্রেমাস্পদকে পাওয়ার জন্য কী ব্যাকুল আকাঙ্ক্ষা প্রতিটি কাহিনিতে। দেহহীন প্রেমের কথা তারা ভাবেনি। দেহাতীত প্রেমের বিশুদ্ধ রূপটি বাস্তবে কতখানি সত্য, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে অনেক লেখকই বিশ্বাস করতেন, প্রকৃত প্রেম দেহাতীত। আকর্ষণের মধ্য দিয়ে যার জন্ম, বিকর্ষণের মধ্য দিয়ে তাকে চিরন্তন করে রাখতে হয়। শেষের কবিতায় দেহাতীত প্রেমের স্বতন্ত্র অবস্থান রবীন্দ্র-জীবনদর্শনের প্রকাশ। লাবণ্যের সঙ্গে অমিতের যে প্রেম, সেটি শাশ্বত অপরিবর্তিত রাখতে চেয়েছে। দৈনন্দিন জীবনের হিসাব-নিকাশ সেখানে আনতে চায়নি।
আজকে প্রেম করে বিয়ে করাটা স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয় অধিকাংশ পরিবার। কিন্তু দেড় শ বা দু শ বছর আগে কল্পনাও করা যেত না। পাশ্চাত্য শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রভাবে তখন আধুনিক বাঙালি পুরুষেরা প্রেম করে বিয়ে করার স্বপ্নে বিভোর ছিল। মাইকেল মধুসূদন দত্ত ভালোবেসে রেবেকাকে বিয়ে করার জন্য গৃহত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রেম করে বিয়ে করতে পারেননি, কিন্তু জ্ঞানদানন্দিনীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক স্থাপন করেই দাম্পত্য সম্পর্কে প্রবেশ করেন। এই দম্পতি পরবর্তী সময়ে রোল মডেলে পরিণত হন।
দাম্পত্য জীবনে প্রেম-ভালোবাসা না থাকলে, সে সংসারে সুখ-শান্তি কোনোটাই থাকে না। দাম্পত্য সুখের জন্য উভয়কেই যত্নশীল হতে হয়। এখন নারী-পুরুষ সবাই সংসারে বন্ধুত্বপূর্ণ, সম্মানজনক সহাবস্থান আশা করে। অবশ্য এখনো কিছু পুরুষ স্ত্রীর কাছে অধীনতা আশা করে! পরস্পর বোঝাপড়াটা থাকা খুব জরুরি। সঙ্গীর মতামতকে গুরুত্ব দিতে হয়। সম্পর্কের প্রতি দায়িত্বশীল হতে হয়। অবজ্ঞা বা অবহেলা ভালোবাসার সম্পর্ককে জটিল পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দেয়। একজন মানুষ আরেকজনের পুরোপুরি মনের মতো না-ই হতে পারে। একসঙ্গে ভালো থাকতে হলে দুজনকেই মানিয়ে নেওয়া ও মেনে নিতে হয়। চেষ্টা করতে হয় ভালো থাকার জন্য। সম্মান না করলে সম্মান পাওয়া যায় না।
সন্দেহ ভালোবাসাকে নিঃশেষ করে দেয়। ভালোবাসার সম্পর্ককে সব সময় সুন্দর রাখার অন্যতম শর্ত হচ্ছে বিশ্বাস। বিশ্বাস একবার ভেঙে গেলে ভালোবাসার সম্পর্কে সব সময় একটা সন্দেহ কাজ করে, যা তাল-লয়-ছন্দ ছাড়া একটা গানের মতো বেসুরো হয়ে যায়। তাই প্রেম বা দাম্পত্য ভালোবাসায় ‘বিশ্বাস’ ভঙ্গ করা কখনো উচিত না। প্রতারণা করা কখনো উচিত না। মানুষের মন একটা অদ্ভুত রকমের। প্রেম কখনো বলে-কয়ে আসে না। প্রেম মানে না সমাজ সংসার, লোকলজ্জা, চক্ষুলজ্জা! তাই সম্পর্কের ক্ষেত্রে সৎ থাকতে হবে। প্রতারণা নয়, সম্পর্ককে সম্মান করতে হবে। আমাদের বাঙালি সমাজে প্রতারণা কেন যেন একটু বেশি। দাম্পত্য সম্পর্ক রেখেও গোপনে আরেকটি প্রেমের সম্পর্ক স্থাপন করে, যা আসলে প্রতারণা। যেকোনো একটি সম্পর্কে সৎ থাকা উচিত।
নারী-পুরুষ সম্পর্ককে কোনো ছাঁচে ফেলা যায় না। এত বেশি পরিবর্তন হয়, মানুষের মনের তা নিয়ন্ত্রণ করাও অনেক সময় কঠিন হয়ে যায়। মানুষের আবেগ, ভালোবাসা, কষ্ট, যন্ত্রণার অনুভূতিগুলো দেখানো যায় না, অনুভব করা যায়। তাই, ভালোবাসার মানুষটির যত্ন নিতে হয়। তার ইচ্ছা-অনিচ্ছা, ভালো লাগা-মন্দ লাগাকে গুরুত্ব দিতে হয়। যেকোনো মূল্যে বিশ্বাস বা আস্থার জায়গাটা ঠিক রাখতে হবে। নৈতিকতাবোধ ভালোবাসায় থাকাটা খুব জরুরি। সম্পর্কের প্রতি সৎ থাকতে হবে। তাহলেই দাম্পত্যজীবন মধুর হয়।
কদিন আগে হঠাৎ খেয়াল হলো, ফেসবুকে লিখলাম—ভালোবাসার আসলে সংজ্ঞা কী? প্রত্যেকে নিজের মতো করে উত্তর দিল। যেমন কলকাতা থেকে শুভ্রা সেনগুপ্ত বসাক লিখেছেন, ‘ভালোবাসা এমন একটা অনুভূতি, যা থাকলে মনে হয় বড় বালাই। একে কোথায় রাখি আর যার অভাবে মনে হয় বেঁচে থাকা অর্থহীন। যার গভীরতা মাপতে গেলে খেই হারাতে হয়। যার দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতা মাপতে গিয়ে দিশেহারা গণিতজ্ঞ। তার সুলুক সন্ধান করতে পারে রক্তকরবীর নন্দিনী আর বিশুপাগল। রাজা জানে, যাকে পাওয়া যায় না তাকে ভাঙাও এক রকম করে পাওয়া। অথচ রঞ্জনের কাছে শিখতে হয় ভালোবাসার জন্য মরে যাওয়াও যায়। কিংবা উত্তীয় যখন বলে “ন্যায় অন্যায় জানিনে জানিনে জানিনে শুধু তোমারে জানি” এও ভালোবাসা। কিংবা বনলতা সেনের মিস্টিক অ্যাপিয়ারেন্স পরাবাস্তবতা, সেও এক ভালোবাসার প্রকাশ। সবশেষে ভালোবাসা হলো এক জঙ্গম শিল্পকলা, যার নির্মাণ আছে কিন্তু ক্ষয় নেই।’
আরিফা রুমার কাছে, ‘ভালোবাসা হচ্ছে রাতদিন তার জন্য বুঁদ হয়ে থাকা।’
আহকামউল্লাহ বলল, ‘ভালোবাসার অনুভূতিগুলো বয়সের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হতে থাকে। একসময় “তুজে কই ওর দেখে, তো জ্বলতাহে দিল” তার কাছে ভালোবাসা হচ্ছে এখন “দায়িত্বপালন”! ভালোবাসার মানুষকে ভালো রাখার দায়িত্ব—এই দায়িত্ববোধ অনেক কিছুর…।’
কবি কাজী জহিরুল ইসলাম ও মুক্তি, জহিরের ভালোবেসে বিয়ে, ২২ বছরের দাম্পত্য জীবন, সন্তানদের নিয়ে সুখের সংসার। মুক্তি জহির বলেন, ‘ভালোবাসার বাগানে সম্পর্কগুলো হলো এক একটি জীবন্ত গাছ আর সেই বাগানের মালী হিসেবে নিজেকে বসিয়ে দিয়ে গাছগুলোর পরিচর্যা করলেই ভালোবাসা সুগন্ধ ছড়াতে থাকবে আপনার চারপাশে।’ তাই ভালোবাসার যত্ন নিতে হয়। গাছে পানি না দিলে যেমন গাছটি মরে যায়, ভালোবাসার যত্ন না নিলে ভালোবাসাও মরে যায়! [৩]
[১] ডা. সুলতানা আলগিন, সহযোগী অধ্যাপক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
[২] হাফিংটন পোস্ট
[৩] বিলকিস রহমান দোলা
Leave a Reply